আগে জাতীয় নির্বাচন, নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন—এই প্রশ্নে রাজনীতিতে তুমুল বিতর্ক দেখা গিয়েছিল চলতি বছরের শুরুতে। কিন্তু তখন বিএনপির বিরোধিতার মুখে বিষয়টি হালে পানি না পেয়ে একরকম আলোচনার বাইরে চলে গিয়েছিল।
তবে সম্প্রতি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নতুন করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার দাবি সামনে আনা হয়েছে। নতুন করে দাবিটি সামনে আনার কারণ কী, এর পেছনে কোনো কৌশল আছে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণ অধিকার পরিষদ—এই তিনটি দল গত সপ্তাহে স্পষ্ট করে বলেছে, তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়।
অবশ্য বিএনপি বরাবরই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচন দাবি করে আসছে। যদিও সম্প্রতি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার বিষয়ে নতুন করে দাবি ওঠার পর বিএনপি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি।
বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। এ দাবিতে সব দলকে এক জায়গায় এনে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ তৈরির জন্য সম্প্রতি নিজেদের যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বিএনপি।
২৩ এপ্রিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণ অধিকার পরিষদের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম ও গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক পৃথক বক্তব্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে দুই দলের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে বলে জানান।
এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে নুরুল হক সেদিন বলেছিলেন, ‘গত আট মাসে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি না থাকায় সেবা পেতে মানুষ ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কিছু মানুষ জোর করে আধিপত্য বিস্তার করছে। সে জন্য স্থানীয় নির্বাচন মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের আগে সংস্কারে কিছু সময়ের প্রয়োজন। আবার জাতীয় ঐকমত্যেরও প্রয়োজন। অন্তত তার আগে স্থানীয় নির্বাচন হতে পারে।’
মূলত এই বৈঠক-বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে আয়োজনের দাবি নতুন করে সামনে আসে।
গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের বৈঠকের দুই দিনের মাথায় ২৫ এপ্রিল জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ময়মনসিংহ নগরের সার্কিট হাউস ময়দানে দলের এক অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি আহ্বান জানান। সেদিন শফিকুর রহমান বলেন, ‘একটা নির্বাচন কমিশন হয়েছে। তারা বলেছে, তারা নাকি ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো নির্বাচন উপহার দেবে। আমরা তাদের একটি অ্যাসিড টেস্ট (অগ্নিপরীক্ষা) দেখতে চাই। জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যেটা দিয়ে পাঁচ বছর দেশ শাসন হবে, সেই নির্বাচনের আগে জনগণ এখন সাফার করছে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিধি না থাকার কারণে। আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা দিন। আমরা দেখি, আপনাদের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা কতটুকু। এটার প্রমাণ আপনারা পেশ করুন।’
আনুষ্ঠানিকভাবে দলের পক্ষ থেকে না বললেও নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন চাইছে। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে এ চাওয়ার কথা বলেছেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার দাবি প্রথম দফায় জোরেশোরে আলোচনায় আসে গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে।
গত ৬ জানুয়ারি ঢাকায় জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটের (এনআইএলজি) সম্মেলনকক্ষে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। মতবিনিময়ে কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতীয় পর্যায়ে সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হলেও ঢাকার বাইরে মানুষের মতামতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রাধান্য পাচ্ছে। ঢাকার বাইরে মতবিনিময় করতে গিয়ে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন এ চিত্র পাচ্ছে।
গত ৮ জানুয়ারি ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের (ইআইবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে মত দেয় জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি নেতাদের পূর্বতন প্ল্যাটফর্ম) ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার পক্ষে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষ থেকে হয়নি।
অন্যদিকে বিএনপির নেতারা শুরু থেকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাঁরা আগে চান, জাতীয় নির্বাচন।
গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দলের নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেখা গেছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এনসিপির আত্মপ্রকাশের পর মার্চে রোজার মধ্যে দলটির নেতাদের কেউ কেউ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার পক্ষে বক্তব্য দেন। যেমন গত ১৯ মার্চ এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ কুমিল্লা শহরতলির শাসনগাছা বাস টার্মিনালে এক গণ-ইফতার অনুষ্ঠানে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন।
তবে দল গঠনের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার চেয়ে এনসিপির জ্যেষ্ঠ নেতারা গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে বেশি সরব হন।
শুরু থেকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চাওয়ার দাবির কড়া সমালোচনা দেখা গেছে বিএনপির নেতাদের মুখে। মিত্রদলগুলোর কেউ কেউ বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে কণ্ঠ মেলান। মূলত বিএনপির বিরোধিতার মুখে অন্যান্য দলও কার্যত স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে আয়োজনের দাবি আর সেভাবে সামনে আনেনি।
সরকারের পক্ষ থেকেও আর এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য আসেনি। সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারির পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা কমে যায়।
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও গণ অধিকার পরিষদ বিষয়টিকে নতুন করে সামনে আনার আগে ২০ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।
প্রতিবেদন দাখিল–পরবর্তী সংবাদ ব্রিফিংয়ে কমিশনের কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চান, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে তারা কী সুপারিশ করেছে? জবাবে কমিশনপ্রধান স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ইচ্ছা করেই এ বিষয়ে স্পষ্ট করে তাঁরা কিছু বলেননি। তাঁরা বলেছেন, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিক। স্থানীয় সরকার নির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ। একটি করলে আরেকটি করা যাবে না, এ-জাতীয় শর্তই অমূলক কথা। দুটিই করতে হবে। তবে তাঁরা চান, স্থানীয় সরকার নির্বাচন অবিলম্বে করা হোক।
গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার দাবি রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল। কিন্তু মার্চে রোজার সময় ও ঈদুল ফিতরের পর গত কয়েক সপ্তাহে বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা দেখা যায়নি। অনেকটা আলোচনার বাইরে চলে যাওয়া এ দাবি নতুন করে কেন সামনে এল, তা রাজনীতিতে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে সারা দেশে একধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। সেই পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কারণে দলের তৃণমূলে কোন্দল-বিভাজন তীব্র হতে পারে। এই বিশৃঙ্খলার প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলের ওপর পড়তে পারে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন যেহেতু কথা বলার পরিবেশ আছে, তাই বিভিন্ন দল তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে। সে জন্য হয়তো সবাই নিজ নিজ বক্তব্য দিচ্ছে। তবে বিএনপি মনে করে, জাতীয় নির্বাচনই আগে হওয়া উচিত। উল্লেখ্য, যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল, তখনো ওই সরকারের অধীন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়নি।’
অন্যদিকে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাওয়া দলগুলোর নেতারা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলে বিএনপির বাইরে অন্য দলগুলোর প্রার্থীরাও ভালো ফলাফল করতে পারেন। তৃণমূলে তাঁদের পরিচিতি ও অবস্থান আরও সংহত হতে পারে। ফলে দলগুলো সুবিধাজনক অবস্থায় চলে যেতে পারে। বিএনপি সেই ভয়েই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাইছে না।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার দাবি নতুন করে সামনে আনার বিষয়টি বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল কিংবা আগামী জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত কি না, সেই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার দাবি সামনে আনা দলগুলোর মধ্যে এ বিষয়ে কোনো অভ্যন্তরীণ সমঝোতা আছে কি না, সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নতুন করে দাবিটিকে সামনে এনেছেন, বিষয়টি এমন নয়। শুরু থেকেই তাঁর দল বিষয়টি নিয়ে সরব। তাঁরা সব সময়ের জন্য জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান। কারণ, দলীয় সরকারের সময় সংসদ সদস্যরা স্থানীয় সরকারে নিজস্ব লোক বা স্বজনদের বসান। ফলে স্থানীয় সরকার কার্যকর হতে পারে না।
আপনার মতামত লিখুন :